সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পের মধ্যে সবার ওপরে পদ্মা সেতু প্রকল্প। তবে এই প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদার দাবি করেছে, বিদ্যুৎ-সংকটের কারণে ঠিকভাবে প্রকল্পের কাজ করা যাচ্ছে না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাবে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রপাতিরও ক্ষতি হচ্ছে। তারা বলেছে, প্রকল্পের জাজিরা প্রান্তে দিনে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।
বিদ্যুতের এই সংকটের আশু সমাধান চেয়ে মূল সেতুর কাজ পাওয়া চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) চিঠি দিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু বিভাগকে। আর সেতু বিভাগ প্রকল্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে।
এমবিইসি বর্তমানে পদ্মা নদীর মাঝখানে ও তীরে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ করছে। সেতু বিভাগের পরিকল্পনা অনুসারে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পিলার নির্মাণ করে স্টিলের কাঠামো স্থাপন করার কথা।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর এক প্রান্ত মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পড়েছে, অন্য প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরায়। জাজিরা অংশের টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক, নির্মাণ অবকাঠামো ও কর্মকর্তাদের থাকার জায়গার অনেক কিছুই পড়েছে মাদারীপুরে। এ জন্য মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচর—এই তিন জেলার তিন উপজেলাতেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের কোনো-না-কোনো কাজ হচ্ছে। এই তিন উপজেলাতেই প্রকল্পের অবকাঠামো রয়েছে। ঠিকাদারের চিঠি ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মুন্সিগঞ্জ অংশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এখন মোটামুটি ভালো। তবে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর অংশে বিদ্যুতের সমস্যা প্রকট।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। তবে প্রকৃত উৎপাদন সর্বোচ্চ ৮ হাজার ১৭৭ মেগাওয়াট। উৎপাদিত বিদ্যুতের একটা অংশ চলে যায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার ও সঞ্চালনে সিস্টেম লসে।
জানতে চাইলে পল্লী বিদ্যুতের শরীয়তপুরের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সোহরাব আলী বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে একান্ত দরকার না হলে আমরা লোডশেডিং দিই না। তবে তা ১২ ঘণ্টা নয়। কারিগরি ত্রুটি হলেও বিদ্যুৎ থাকে না। এর মধ্যে সম্প্রতি গাছ কাটার কর্মসূচির কারণে পুরো এক দিন বিদ্যুৎ ছিল না।’
সেতু বিভাগের সূত্র বলেছে, প্রকল্পের অগ্রগতিসংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য ৪ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, প্রকল্পের পরামর্শক, বিশেষজ্ঞ কমিটিকে নিয়ে বৈঠক করেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। বৈঠকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ-সংকটের বিষয়টি জানায়। পরদিন তারা প্রকল্প পরিচালক বরাবর আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়। চিঠিতে বলা হয়, জাজিরা প্রান্তে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকে না। তাদের যে জেনারেটর আছে, তা দিয়েও এই সংকট মেটানো যাচ্ছে না। বরং অত্যধিক চাপের কারণে জেনারেটর যেকোনো সময় বিকল হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় একটি বিশেষ লাইনের মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুরোধ করে এমবিইসি।
এমবিইসির চিঠি পাওয়ার পর সেতু বিভাগ গত সোমবার বিদ্যুৎ বিভাগ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে চিঠি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুরোধ জানায়। চিঠিতে বলা হয়, অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্প (ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট) পদ্মা সেতু নির্মাণে ঠিকাদারদের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ভোল্টেজ ঘাটতি এবং কখনো কখনো ১২ ঘণ্টার অধিক বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকায় সেতুর নির্মাণকাজ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি যন্ত্রপাতিরও ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের স্বার্থে প্রয়োজনীয় ভোল্টেজসহ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য উচ্চক্ষমতার বিদ্যুতের লাইন দরকার। মূল সেতুর কাজ যতটা এগোবে, বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে। কারণ, মূল সেতুর মূল উপাদান স্টিল। আর স্টিল দিয়ে সেতু নির্মাণের প্রতিটি স্তরেই বিদ্যুতের দরকার। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে জেনারেটর আছে। তবে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট এতই প্রকট যে জেনারেটরেও সমাধান করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই ঠিকাদারের চিঠি পেয়ে তাঁরা বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছেন।
২০১৮ সালে পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মোট অগ্রগতি ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষের দিকে। মূল সেতুর পরীক্ষামূলক পাইলিং চলছে। আর নদীশাসনের লক্ষ্যে চলছে ব্লক নির্মাণ ও নদী খননকাজ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের নদীশাসনের কাজ করছে চীনের আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড।
নকশা অনুসারে পদ্মা সেতু হবে দ্বিতলবিশিষ্ট। এর ওপরের অংশ দিয়ে চলবে পরিবহন। আর নিচতলা দিয়ে ট্রেন চলাচলের পথ থাকবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে এবং সেতু রেললাইন নির্মাণে প্রকল্প নিয়েছে। তবে রেলের কাজ এখনো কাগজে-কলমে, পথ চিহ্নিত করা এবং প্রকল্প তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ।


