একটু বিরক্ত হয়েই প্রশ্নটির উত্তর দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবারের সংবাদ সম্মেলনের শেষের ভাগে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নটি ছিলো এমন, ‘ফোরবসের র্যাংকিংয়ে আমরা দেখছি আপনি বিশ্বের ৩৬তম ক্ষমতাধর নারী। র্যাংকিংয়ে আপনি কততম হলে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হয়ে সকল অর্জন ভয়হীন শঙ্কাহীনভাবে সেলিব্রেট করতে পারবো?’
উত্তর দিতে কিছুটা বিরক্তই মনে হলো প্রধানমন্ত্রীকে। অডিয়েন্সের যে দিকটাতে রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা ছিলেন সেদিক থেকে একটু ‘ধুয়ো’ও উঠলো প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে।
কিন্তু দ্রুতই সামলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নটির উত্তর দিলেন এভাবে- ‘আমি রাজনীতি করি বাংলাদেশের জনগণের জন্য। বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই আমার লক্ষ্য। আমি র্যাংকিং নিয়ে মোটেই চিন্তা করি না, চিন্তা করবোও না। কে কি দিলো, না দিলো সে নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই। এটা নিয়ে আমার কোনও প্র্রশ্নও নেই, উৎসাহও নেই। কে আমাকে র্যাংকি দিচ্ছে কে দিচ্ছে না, সেটা আমার ভাবনার বিষয় না। আমার ভাবনা জুড়ে থাকে দেশের উন্নতি। দেশের মানুষের কতটুকু কল্যাণ হলো। জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বে কতটুকু সম্মান অর্জন করতে পারলাম সেটাই।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, যেই দেশ আমরা দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন করেছি লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, সেই দেশকে যখন কেউ অবহেলার চোখে দেখে সেটাই আমার জন্য কষ্টের ছিলো। আমার চেষ্টা ছিলো, আমরা কারো কাছে হাত পাতবো না, কারো কাছে ভিক্ষা চাইবো না। আমরা মাথা উঁচু করে চলবো।
জাতির পিতা যা সবসময়ই বলতেন, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াবো। সেটাই হচ্ছে বড় কথা। এখন দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি রাষ্ট্রপ্রধান, বিভিন্ন সংস্থার প্রধানরা যখন বলেন, বাংলাদেশের যে অর্জন সেটা মিরাকল তখন আমার আনন্দ লাগে। তারা প্রশ্ন করেন, আপনি এটা করলেন কি করে! কেউ আবার জানতে চান, ম্যাজিকটা কী!
আমি বলি, ম্যাজিক একটাই দেশের জনগণ। জনগণের ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আস্থা, বলেন শেখ হাসিনা।
‘আমি নিজের স্বার্থের জন্য রাজনীতি করি না। একটাই চাওয়া, বাংলাদেশের মানুষ যাতে ভালো থাকে।’
তিনি বলেন, এই যে দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি করতে পারছি, দারিদ্র বিমোচন করতে পারছি এটাই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পরে কী করেছিলেন সে স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময় মাঠ-ঘাট-খাল-বিল কোথায় না গেছি! কোথাও গাড়ি, কোথাও নৌকা, কোথাও মাছের ট্রলার, কোথাও পায়ে হেঁটে, কোথাও রিক্সায় চড়ে, কোথাও ভ্যানগাড়ি চেপে সারা বাংলাদেশ ঘুরেছি। তখন দেখেছি বাংলাদেশের মানুষের কষ্ট। তারা খেতে পায়না, পরনের কাপড়টা জীর্ণ-শির্ণ। তখন মানুষের কাছে গেছি, মানুষ হাত পেতেছে। তারা খাবার চায়, ভাত চায়।
শেখ হাসিনা বলেন, এই যে ভাতের জন্য আকুতি, ছিন্ন কাপড় পরা আমার মা-বোন, রাস্তা-ঘাট কিছু নেই সে অবস্থাই দেখেছি। ধান ক্ষেতের আল দিয়েও হেঁটে গেছি, গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। তখন দেশের পরিস্থিতি কি দেখেছি, আর আমাদের জাতির পিতা কি চেয়েছিলেন সেটা মিলিয়ে দেখেছি। এরপর যখনই সরকারে এসেছি তখনেই চেষ্টা করেছি। তাই দেশের মানুষ এখন দুই প্রস্থ কাপড় পাচ্ছে, তার পায়ে স্যান্ডেল আছে, দুই বেলা খেতে পাচ্ছে। একেকটা ধাপে ধাপে আমরা এই জিনিষগুলোই নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, একটা রাজনৈতিক দল হিসেবে যদি নিজস্ব পরিকল্পনা না থাকে, বা ভবিষ্যত কর্মপন্থা সুনির্দিষ্ট করার উদ্যোগ না থাকে তাহলে দেশকে উন্নত করা যায় না। আমাদের দলকে আমরা সেইভাবেই প্রস্তুত করেছি।
আজ দেশ যখন এগুচ্ছে, দেশের মানুষ যখন সম্মান পাচ্ছে, এটাই আমার বড় পাওয়া। দেশের মানুষের ভালো থাকাই আমার সবচেয়ে বড় পুরষ্কার, আর কিছু নয়।
মাটি ও মানুষের কাছ থেকে শিখে আমরা কাজ করি। ফলে এই এগিয়ে যাওয়া ম্যাজিক নয়, আর কিছুই নয়। এটা স্রেফ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ, যেটা আমার বাবা করে গেছেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
বাবার কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষা থেকেই কাজ করে যাচ্ছি, তার যে স্বপ্ন ছিলো, যে দারিদ্রমুক্ত ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার, সেটা করে যাচ্ছি আর সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কোন পত্রিকা আমাকে কি দিলো না দিলো সে নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যাথা নেই, বলেন তিনি।
র্যাংকিং পেতে কত কিছু করতে হয়, আমি তো কিছু করি না। লবিস্ট নিয়োগ করতে হয় এটা, সেটা। বরং যেই টাকা খরচ হবে তা দিয়ে একটা ঘর করে দেবো, খাবারের ব্যবস্থা করে দেবো, কর্মসংস্থান করে দেবো সেটাই আমার বড় পাওয়া। পুরস্কারের চিন্তা আমার নেই।
আরও অনেক বড় বড় অফার আসে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারও আমার কোনও দরকার নেই। আমার দেশের মানুষ খেতে পেলে সেটাই আমার বড় পুরস্কার। তাতে আমার আব্বার আত্মাটা শান্তি পাবে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমি যে ওমরাহ করতে গেছি, বা নবী করিম (সঃ)’র রওজায় মোনাজাত করেছি, তখন আমি একটা জিনিষই খোদার কাছে চেয়েছি যে, খোদা আমার এই দুটি হাত দিয়ে এদেশের মানুষের যেনো কল্যাণ হয়।
এটুকুই চাওয়া। এর বাইরে আর কোনও চাওয়া নেই আমার। দেশের মানুষ খুশি হলেই আমি খুশি।
উল্লেখ্য ফোরবস ম্যাগাজিনের এবারের র্যাংকিংয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের মধ্যে ৩৬তম হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগের বছর র্যাংকিংয়ে তিনি ছিলেন ৫৯তম।
বাংলাদেশ সময় ২১০০ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৬